নীহারেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়: পদ্মের মতো চোখের উপমা দিয়ে দৃষ্টিহীন ছেলের নাম রাখা নিয়ে একটি প্রবচন প্রচলিত আছে বাংলা ভাষায়। নামকরণের বিপর্যয় অর্থাৎ নামের সঙ্গে চরিত্রের অমিল বোঝাতে প্রায়শই এই প্রবচনটি ব্যবহার করা হয়। নামকরণ করেন সাধারণত শিশুর অভিভাবকেরা। ভবিষ্যতে সেই নামটিকে সে নিজেই ভেঙচি কাটবে কিনা সেটা জানা কোনও অভিভাবকের পক্ষেই একটি শিশুর নামকরণের সময় জানা সম্ভব হয় না। সুতরাং বহু মানুষের ক্ষেত্রেই চরিত্র ও নামের অসঙ্গতি দেখা যায়। কিন্তু বিষয়টি ব্যতিক্রমী হয়ে ওঠে যখন কেউ পিতৃদত্ত নাম বদলে নিজেই নিজের নামকরণ করেন এবং নামের বিপরীত কাজকর্মে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেন। ঠিক এইরকমই একটি কাজ করেছিল আমেরিকার প্রথম নথিভুক্ত সিরিয়াল কিলার এইচ এইচ হোমস (H. H. Holmes)।

১৮৬১ সালে আমেরিকার নিউ হ্যাম্পশায়ারে জন্মগ্রহণ করা হোমস ২৪ বছর বয়েসে তার তরুণী বধু ও সন্তানকে পরিত্যাগ করে ১৮৮৫ সালে ডেরা বাঁধে শিকাগো শহরে। ইলিওনিস প্রদেশের এই বিখ্যাত শহরে এসে সে দুটি কাজ করে। প্রথমেই স্যার আর্থার কোনান ডয়েল সৃষ্ট বিখ্যাত গোয়েন্দা চরিত্র শার্লক হোমস–এর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে নিজের পদবি পরিবর্তন করে রাখে হোমস। দ্বিতীয়ত সে একটি ওষুধের দোকানে চাকরি নেয়। এই পর্যন্ত ব্যাপারটি নিস্তরঙ্গই ছিল। কিন্তু কিছুদিন পর থেকেই হোমসের পরিবর্তন হতে শুরু করে। অত্যন্ত আকর্ষণীয় চরিত্রের হোমস একজন প্রথম শ্রেণীর জালিয়াতে পরিণত হয়। একটি খালি জমি কিনে তার ওপর একটি বাড়ি তৈরি করে, যে বাড়ি তৈরির টাকা সে জোগার করেছিল ওষুধের দোকানের মালিকদের প্রতারিত করে।

এর কিছুদিন পর অর্থাৎ ১৮৯৩ সালে ক্রিস্টোফার কলম্বাসের আমেরিকা পদার্পণের চারশ বছর পূর্তি উপলক্ষে শিকাগো শহরে একটি বিরাট বাণিজ্যমেলার আয়োজন করা হয়। সেই সময়ের অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার মধ্যেও মেলা উপলক্ষে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে শিকাগোয় প্রায় ২ কোটি ৭০ লক্ষ লোকের সমাগম হয়। হোমস এই বিপুল জনসমাগমের সুযোগ নেয়। স্বাভাবিক ভাবেই মেলায় কাজ পাওয়ার আশায় বেশ কিছু মানুষও এসে উপস্থিত হন শিকাগোয়। এদেরই কয়েকজন, যার মধ্যে কয়েকজন মহিলাও ছিলেন, হোমসের শিকারে পরিণত হয়। তার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল এই ভাগ্যান্বেষণে আসা মানুষদের সর্বস্বান্ত করে খুন করে ফেলা। কিন্তু খুন করার পর প্রমাণ লোপাট করার জন্য মৃতদেহ লোপাট করা আদৌ সহজ নয়। সেই কাজটি নির্বিঘ্নে সম্পন্ন করার জন্য হোমস আগে থেকেই প্রস্তুতি নিয়ে তার বাড়ির নকশা তৈরি করেছিল।

পরবর্তীকালে হোমসের বাড়ির নকশা দেখে তাজ্জব বনে গিয়েছিলেন দুঁদে পুলিস অফিসাররা। বাড়িটি ছিল একটি মারাত্মক ফাঁদ। শব্দ নিরোধক (soundproof) ঘর, গোপন চলাচলের পথ, সিঁড়ি ও ঘরের গোলকধাঁধা সহ প্রত্যেকটি ঘরের মধ্যে ছিল একটি আপাতনিরীহ দরজা যার সঙ্গে লাগানো ছিল একটি চ্যানেল। এই চ্যানেলের মাধ্যমে মৃতদেহগুলিকে সরাসরি নামিয়ে দেওয়া হত বাড়ির নীচে। অ্যাসিডের পাত্র, কলিচুনের স্তূপ রাখা নীচের তলাটি ছিল মৃতদেহের শেষ বন্দোবস্ত করার স্থান। তৎকালীন সংবাদপত্রের এই বর্ণনার মধ্যে কিছুটা অতিরঞ্জন থাকলেও হোমসের বাড়ি যে একটি ভয়ঙ্কর মৃত্যুফাঁদ ছিল সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। পরবর্তীকালে এই বাড়িটি পরিচিত হয় ‘মার্ডার ক্যাসেল’ (Murder Castle) বা খুনে কেল্লা নামে।

একটি বিমা কোম্পানির প্রতারণায় হোমসের সহকারী বেঞ্জামিন পিটিজেল ও তার দুই শিশুকন্যাকে খুন করায় অবশেষে এই সিরিয়াল কিলার ধরা পড়ে। আশ্চর্যের বিষয় হল তার এই খুনের ব্যাপারে পিটিজেলের স্ত্রীও কিছু বুঝতে পারেননি উল্টে হোমস সেই মহিলাকে পিটিজেল সম্পর্কে মিথ্যে কথা বলে তার বিমার টাকা আত্মসাৎ করে একসঙ্গে থাকতে শুরু করে! যদিও সেই মহিলা ও তাঁর তিন সন্তানকে খুন করার আগেই হোমসের জায়গা হয় গারদের পেছনে। কিছুদিন কারাবাসের পর ১৮৯৬ সালে ফিলাডেলফিয়ায় হোমসের ফাঁসি হয়।

হোমসের শিকারের সংখ্যা নিয়ে কিছুটা অস্পষ্টতা রয়েছে। জেলে থাকাকালীন হোমস একটি আত্মজীবনী লেখে যার নাম ছিল ‘হোমস–এর নিজের কাহিনী’ (Holmes’ Own Story)। বইটিতে তৎকালীন আমেরিকায় সাড়া ফেলে দেওয়া খুনি দাবি করেছিল যে, সে সর্বমোট ২০০ জনকে খুন করেছে। যদিও পুলিশের ধারণা আসল সংখ্যাটা তার থেকে অনেকটাই কম। সাধারণ মানুষকে শিউরে দেওয়া সেই আত্মকথায় এই সিরিয়াল কিলার এক জায়গায় লিখেছিল, ‘’কবি যেমন কবিতা না লিখে থাকতে পারে না আমিও তেমনি খুন না করে থাকতে পারি না।‘’ হোমসের জীবনীকে কেন্দ্র করে বিখ্যাত বইটি অবশ্য লেখা হয় ২০০৩ সালে। বিক্রির তালিকায় এক সময় শীর্ষে থাকা ‘দ্য ডেভিল ইন দ্য হোয়াইট সিটি’ (The Devil in the White City) নামের বইটির লেখক এরিক লারসেন (Erik Larson)।

এই কুখ্যাত খুনির কীর্তিকলাপ জনমানসে এতটাই প্রভাব ফেলেছিল যে, ফাঁসির একশ বছর পরও মানুষ বিশ্বাস করত, যাকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল সে আসল হোমস নয়। ফাঁসির আগেই সেই জালিয়াত কারারক্ষী ও প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের ঘুষ দিয়ে জেল থেকে সরে পড়েছিল এবং হোমসের বদলে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল অন্য এক ব্যক্তিকে। গুজবটির সত্যতা জানার জন্য ২০১৭ সালে হোমসের বংশধররা আবেদন জানান হোমসের দেহাবশেষের ডিএনএ পরীক্ষা করার। তাঁদের আবেদনে সারা দিয়ে আদালতের নির্দেশে কবর খুঁড়ে দেহাবশেষ বাইরে এনে পরীক্ষা করা হয়। সেই পরীক্ষায় প্রমাণিত হয়, হোমস তার জীবনের শেষ জালিয়াতিটা আর করে উঠতে পারেনি, নির্ধারিত দিনে যাকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়েছিল সে তুমুল জনপ্রিয় কাল্পনিক গোয়েন্দা শার্লক হোমস–এর অনুরাগী আসল সিরিয়াল কিলার এইচ এইচ হোমস।