নীহারেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়: ভারতের রাজনীতিতে গরু একটি নির্ধারক শক্তিতে পরিণত হয়েছে বিগত কয়েকবছর ধরে। স্বাধীনতার পর থেকেই ‘গো–বলয়’ ভারতীয় রাজনীতির ক্ষেত্রে নিয়ামক শক্তি হিসেবে বিবেচিত হলেও রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে গরুর সরাসরি অনুপ্রবেশ মাত্র কয়েক বছর আগের ঘটনা। আমাদের মধ্যে অনেকেরই এমন ধারণা বদ্ধমূল হয়ে রয়েছে যে ‘গরু’ নিয়ে রাজনীতি সম্ভবত ভারতের একচেটিয়া বৈশিষ্ট্য। এ বিষয়ে আমাদের দেশ ‘সেকেন্ড টু নান’। কিন্তু জানলে অবাক হতে হয় জাতীয় অস্মিতার সঙ্গে গরুর সংযুক্তিকরণ ঘটেছিল আজ থেকে প্রায় ৪০ বছর আগে ক্যারিবিয়ান সাগরের একটি দ্বীপপুঞ্জ দেশে। দেশটির নাম কিউবা।

কথাটা শুনলে প্রথমে একটু চমকে ওঠারই কথা কারণ আমাদের দেশের সাম্প্রতিক ঘটনাবলীর নিরিখে ফিদেল কাস্ত্রো ও চে–গেয়েভেরার দেশের উল্লেখ কিঞ্চিত প্রলাপ বলে মনে হতে পারে। কিন্তু গত শতকের সাত ও আটের দশকের ইতিহাসের দিকে তাকালই জানা যায় গো–মুত্রে করোনা মুক্তি বা গো–মাতা সংক্রান্ত বিষয়গুলি বাদ দিলে কমিউনিস্ট কিউবাতে ওই সময় জাতীয়তাবাদী প্রত্যয় ও আত্মবিশ্বাসের প্রতীক হয়ে উঠেছিল গরু। এই বিষয়টিকে প্রতিষ্ঠা করতে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন স্বয়ং ফিদেল কাস্ত্রো।

গত শতকের পাঁচের দশকে ফিদেল তাঁর ৮০ জন অনুচর নিয়ে কিউবার মাটিতে এক দুঃসাহসিক সশস্ত্র বিপ্লব শুরু করেন। রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে ১৯৫৯ সালে বাতিস্তা সরকারের পতন ঘটিয়ে কিউবার ক্ষমতা দখল করেন ফিদেল–চে’র বিপ্লবী দল। প্রথম দিকে আমেরিকা কিউবার এই অভ্যুত্থান সমর্থন করলেও কাস্ত্রো কমিউনিস্ট পার্টিকে আইনি স্বীকৃতি দিলে এবং বাতিস্তা সরকারের প্রাক্তন আমলা, পুলিশ ও সেনাবাহিনীর কয়েকজনকে মৃত্যুদণ্ড দিলে দু’দেশের সম্পর্কের অবনতি হতে শুরু করে। সেই সম্পর্ক এতটাই তিক্ত হয়ে পড়ে যে পরবর্তী সময়ে আমেরিকা কিউবার বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা ঘোষণা করে। কিউবার রাজনীতিতে গরু প্রবেশের পরিপ্রেক্ষিত রচিত হয় এভাবেই ।

কিউবার দেশজ গরুর দুধ বিশেষ হয় না। মূলত মাংসের জোগানের কারণেই সেই দেশে গো–পালনের প্রচলন ছিল। দুগ্ধজাত দ্রব্যের জোগান ঠিক রাখতে আমদানিই ছিল ভরসা। আমেরিকা আর্থিক প্রতিরোধ তৈরি করায় কিউবার প্রধান ভরসা হয়ে ওঠে তৎকালীন সোভিয়েত রাশিয়া এবং পূর্ব জার্মানি। দেশকে কৃষি ও দুগ্ধজাত দ্রব্যে স্বনির্ভর করার লক্ষ্যে কাস্ত্রো সরকার একাধিক পদক্ষেপ গ্রহণ করে। তার মধ্যে অন্যতম হল কানাডা থেকে কয়েক হাজার হলস্টাইন (Holstein) গরুর আমদানি। কিউবার পরিবেশে খাপ খাইয়ে নেওয়ার উপযুক্ত করে তোলার জন্য দেশীয় গরুর সঙ্গে হলস্টাইন গরুর মিলনে এক সংকর প্রজাতির হলস্টাইন গরুই হয়ে ওঠে কিউবার দুধ উৎপাদনের প্রধানতম ভরসা।

১৯৭২ সালে জন্ম নেয় কিউবার প্রবাদপ্রতিম সংকর প্রজাতির গরু ‘উব্রা ব্ল্যাঙ্কা’ (Ubre Blanca)। তার অসামান্য দুধ উৎপাদনের ক্ষমতার কারণে উব্রা ব্ল্যাঙ্কা গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে জায়গা করে নেয়। ১৯৮২ সালে একদিনে ১১০ লিটার দুধ দিয়ে সারা বিশ্বের মানুষকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল ফিদেল কাস্ত্রো’র নয়নের মণি উব্রা ব্ল্যাঙ্কা। রাজনৈতিক ধারাভাষ্যকারদের অভিমত, দুগ্ধজাত দ্রব্য বিশেষ করে আইসক্রিমের প্রতি ফিদেলের অসম্ভব দুর্বলতাই তাঁকে দুধ উৎপাদনের বিষয়ে চূড়ান্ত মনোযোগী করে তোলে। বিখ্যাত লেখক গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কোজ তাঁর স্মৃতিচারণায় জানিয়েছিলেন, লেখকের সঙ্গে এক মধ্যাহ্নভোজ সারার সময় ফিদেল নাকি ১৮ স্কুপ আইসক্রিম খেয়েছিলেন!

উব্রা ব্ল্যাঙ্কা’র ব্যাপারে কিউবান রাষ্ট্র নায়ক এতটাই সংবেদনশীল ছিলেন যে বিদেশি অভ্যাগতরা কিউবায় গেলে তিনি তাঁদের তাঁর প্রিয় গরুটিকে দেখাতে নিয়ে যেতেন এবং অবিরাম বলে চলতেন তার সম্পর্কে নানান কথা । তাঁর রাজনৈতিক বক্তব্যেও জায়গা করে নিত এই অসামান্য গাভীটি। দুধ উৎপাদনে কিউবার স্বনির্ভরতা ছিল আমেরিকার আর্থিক অবরোধের বিরুদ্ধে কিউবার রাজনৈতিক প্রত্যুৎত্তর। আর এই জাতীয়তাবাদী বয়ানের প্রতীক হয়ে উঠেছিল উব্রা ব্ল্যাঙ্কা।

ফিদেলের প্রিয়তম গরুটির জন্য নির্মিত হয়েছিল একটি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘর, দুধ দোহনের সময় সেখানে বাজানো হত বাছাই করা সঙ্গীত। শোনা যায় সিআইএ একাধিকবার ফিদেলের জীবননাশের চেষ্টা চালিয়েছিল বলে তিনি নিজের বিষয়ে যতটা সতর্কতা গ্রহণ করতেন ঠিক ততটাই সতর্কতা গ্রহণ করা হত উব্রা ব্ল্যাঙ্কা’র নিরাপত্তার বিষয়ে। রেকর্ড দুধ উৎপাদনকারী এই গাভীটিকে খাবার দেওয়ার আগে সেই খাবার অন্য গরুদের খাইয়ে তাদের প্রতিক্রিয়া দেখে নেওয়া হত। উব্রা ব্ল্যাঙ্কা’র কাছাকাছি আসতে দেওয়া হত নির্দিষ্ট সংখ্যক মানুষকে। সংকর প্রজাতির এই হলস্টাইন গরুটিকে মুড়ে ফেলা হয়েছিল কঠোর নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যে। নিরাপত্তা রক্ষীদের ঘেরাটোপ অতিক্রম করে কারও পক্ষেই তার কাছে যাওয়ার উপায় ছিল না।

১৯৮৫ সালে তৃতীয়বার অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার পর জটিল রোগে আক্রান্ত হয় কিউবার জাতীয় হিরোতে পরিণত হওয়া উব্রা ব্ল্যাঙ্কা। রোগের চূড়ান্ত পরিণতিতে সেই বছরেই মৃত্যু হয় ফিদেল কাস্ত্রো’র প্রিয়তম গাভীর। সম্পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তার শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়। রাষ্ট্র পরিচালিত সংবাদপত্রের প্রথম পাতা জুড়ে উব্রা ব্ল্যাঙ্কার প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য জানানো হয়। মার্বেল পাথর দিয়ে নির্মিত হয় প্রতিকৃতি। ফিদেল কাস্ত্রো এই মৃত্যুতে এতটাই ভেঙে পড়েন যে তাঁকে কিছুটা সাব্যস্ত রাখতে জাতীয় গ্রন্থাগারের দেওয়াল জুড়ে ঝুলিয়ে দেওয়া হয় উব্রা ব্ল্যাঙ্কা’র বিশাল পোট্রেট যাতে তিনি তাঁর অফিস থেকে সবসময় দেখতে পান তাঁর প্রিয়তম গাভীর ছবি।