ভাগীরথী বা গঙ্গা সন্ধ্যারাগে ঝিলিমিলি এক নদীর তীরে বসে একটি বালকের বিস্ময় আপ্লুত প্রশ্ন ছিল—‘নদী তুমি কোথা হইতে আসিয়াছ?’ অন্ধকার নদীর স্বরে উত্তর আসত, ‘মহাদেবের জটা হইতে’। আরও কত অশ্রুত প্রশ্নোত্তর চলত নির্জন নদীতীরে, বালক আর নদীটির মধ্যে। এ-নদী আমাদের চিরপরিচিত নদী ভাগীরথী আর এ-বালকও আমাদের একান্ত অপরিচিত নন। তিনি আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু। ভাগীরথী নদীর ভৌগোলিক উৎস,তার গতিপথ, আর পৌরাণিক আখ্যান হয়ত সকলের জানা। আর নদীমাতৃক ভারতবর্ষে নদ-নদীর যেমন কোনও অভাব নেই, তেমনি অভাব নেই তাকে নিয়ে গল্পগাথা ও পৌরাণিক কাহিনির। কিন্তু সমস্ত ভারতের হৃদয় জুড়ে গঙ্গার যে জীবন্ত অস্তিত্ব, তার সমস্ত জীবনের পরতে পরতে জড়িয়ে থাকা এ-নদীর প্রাণপ্রবাহকে কেউ অস্বীকার করতে পারি না। ভারতবাসীর ধর্মে ও প্রতিদিনের আচার আচরণে, তার সভ্যতা-সংস্কৃতি, লৌকিক আচারের সঙ্গেও ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে নদীকথা। আর গঙ্গার দেবীমাহাত্ম্য বর্ণিত হয়েছে বিভিন্ন পুরাণগুলিতে, মহাভারতে, বেদে। বৈদিক যুগে ভারতের প্রধান নদী ছিল সরস্বতী। পরবর্তিকালে গঙ্গা সেই স্থান অধিকার করে। গঙ্গা আজ ভারতের প্রাণগঙ্গা। তার বহু নাম। পতিতপাবনী, পতিতোদ্ধারিণী, জাহ্নবী, সুরধুনী— আরও কত কী!

গঙ্গার যাত্রাপথ
গাড়োয়াল হিমালয়ের গঙ্গোত্রী হিমবাহের প্রান্তে প্রায় চার হাজার মিটার উঁচুতে গোমুখ নামে তুষার গহ্বর (Snout) গঙ্গার উৎস। সেখান থেকে আটাত্তর কিমি দূরে উত্তরকাশী পর্যন্ত নদী দক্ষিণাভিমুখী। এরপর আবার দক্ষিণে বেঁকে টিহরি হয়ে তা দেবপ্রয়াগে পৌঁছেছে। এ-পর্যন্ত নদীটির নাম ভাগীরথী। দেবপ্রয়াগে ভাগীরথী ও অলকানন্দার সঙ্গম। তারপর এই সম্মিলিত জলধারা গঙ্গা নাম নিয়ে শিবালিকের থেকে বেরিয়ে দক্ষিণ-পশ্চিমে ঘুরে হরিদ্বারে নেমেছে। হরিদ্বার থেকে গঙ্গা সমতলে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্বে প্রবাহিত। ভাগলপুর হয়ে গঙ্গা পশ্চিমবঙ্গের উত্তর প্রান্তে রাজমহল পাহাড়ের গা-ঘেঁষে প্রায় খাড়া দক্ষিণে নেমে পশ্চিমবঙ্গে প্রবেশ করেছে। জঙ্গিপুরের কাছে মিঠাপুরে গঙ্গা দু ভাগে ভাগ হয়েছে। পূর্ব শাখাটির নাম পদ্মা, যেটা বাংলাদেশের মধ্যে দিয়ে প্রায় দুশো কুড়ি কিলোমিটার বয়ে গিয়ে যমুনা (ব্রহ্মপুত্র মূল স্রোত) এবং মেঘনার সঙ্গে যুক্ত হয়ে সমুদ্রে মিশেছে। ভাগীরথী নামে গঙ্গার অপর শাখাটি বহু বাঁক নিয়ে দক্ষিণে নেমে গঙ্গাসাগরে মিশেছে। মোহনা পর্যন্ত ভাগীরথী প্রায় পাঁচশো ষাট কিলোমিটার দীর্ঘ। গঙ্গার সম্পূর্ণ প্রবাহ পথটি দু হাজার পাঁচশো পঁচিশ কিলোমিটার দীর্ঘ।
এই বিরাট অঞ্চল পরিক্রমণ কালে পথে মিলিত হয়েছে বহু উপনদী ও শাখা নদীর সঙ্গে। আর এক-এক অংশে তার নামও বদলে গিয়েছে। কোথাও সেই সঙ্গে জন্ম দিয়েছে বিভিন্ন কাব্যকাহিনি, পুরাণকথা ও ধর্মীয় উৎসবের। সেরকমই একটি উৎসব বিষহরা। এর সঙ্গেও জড়িয়ে আছে পৌরাণিক কাহিনি।
পৌরাণিক আখ্যানে গঙ্গার জন্ম

গঙ্গাকে নিয়ে পুরাণে বহু কাহিনি রয়েছে। একটি কাহিনি অনুযায়ী ব্রহ্মার কমণ্ডলু এক নারীমূর্তির রূপ পায়। ইনিই গঙ্গা। বৈষ্ণব মতানুসারে, ব্রহ্মা তাঁর কমণ্ডলুর জল নিয়ে সশ্রদ্ধ চিত্তে বিষ্ণুর পদ ধৌত করেছিলেন। সেই থেকেই গঙ্গার জন্ম। তৃতীয় একটি মত অনুযায়ী, গঙ্গা পর্বতরাজ হিমালয় ও তাঁর পত্নী মেনকার কন্যা এবং পার্বতীর ভগিনী। তবে প্রতিটি মতেই এ-কথা স্বীকৃত যে ব্রহ্মা গঙ্গাকে পবিত্র করে তাঁকে স্বর্গে উত্তীর্ণ করেন।

তেমনি একটি কাহিনি অনুসারে গঙ্গার জন্ম হয় বিষ্ণুর দেহ থেকে। নারদের অনুরোধে মহাদেবের গান শুনে বিষ্ণু আংশিক দ্রবীভূত হলে, ব্রহ্মা তা তাঁর কমণ্ডলুতে ধারণ করেন। বিষ্ণুর এই দ্রবীভূত অংশই গঙ্গা নামে খ্যাত হয়।

আরও পড়ুন- পলিসিসটিক ওভারিয়ান সিন্ড্রোম রোগ নিরাময়ে ডার্ক চকলেটের ভূমিকা

আর এক মতে তিনি বিষ্ণুর স্ত্রী। বিষ্ণুর তিন স্ত্রী যথাক্রমে লক্ষ্মী, সরস্বতী ও গঙ্গা। একসময় গঙ্গার প্রতি অত্যন্ত আকৃষ্ট হয়ে পড়েন বিষ্ণু। এতে লক্ষ্মী বিষ্ণুকে ক্ষমা করলেও সহ্য করতে পারেননি সরস্বতী। গঙ্গা ও সরস্বতীর মধ্যে বিরোধ ও কলহের ফলে সরস্বতীর অভিশাপে গঙ্গা নদীতে পরিণত হন। শাপগ্রস্ত গঙ্গাও ওই একই অভিশাপ দিলেন সরস্বতীকে। বিষ্ণুর এই দুই স্ত্রী নদীরূপে পরিণত হয়ে প্রবাহিত হলেন মর্ত্যলোকে।

ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের কাহিনিত পাই গঙ্গা ও কৃষ্ণের প্রেমকাহিনি ও তার ফলে রাধারানী রেগে গিয়ে শ্রীকৃষ্ণকে তিরস্কার করে গঙ্গাকে গণ্ডূষে পান করতে যান। উপায় না দেখে গঙ্গা আশ্রয় নিলেন শ্রীকৃষ্ণের শ্রীচরণে। এতে সারা পৃথিবী জলশূন্য হবার উপক্রম হল। দেবতারা শরণাপন্ন হলেন কৃষ্ণের। তখন কৃষ্ণ তাঁর নখাগ্র থেকে বার করে দিলেন গঙ্গাকে। সেই থেকে গঙ্গার নাম হল বিষ্ণুপদী। পরে ব্রহ্মার অনুরোধে কৃষ্ণ গন্ধর্বমতে বিবাহ করেছিলেন গঙ্গাকে।

তবে গঙ্গাকে নিয়ে মূল কাহিনিটি হল ইক্ষ্বাকু রাজবংশের রাজা সগরের ষাট হাজার ছেলে কপিল মুনির অভিশাপে ভস্ম হয়ে যান। সগররাজার নাতি রাজপুত্র ভগীরথ রাজা হওয়ার পর গুরু ত্রিথলের উপদেশে তিন হাজার বছর ধরে হিমালয়ে প্রবল তপস্যা করেন এবং ৬০,০০০ অভিশপ্ত পূর্বপুরুষদের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করেন। এরপর তিনি কপিলমুনির অভিসম্পাত থেকে তাঁদের উদ্ধারের জন্য দেবী গঙ্গাকে সন্তুষ্ট করার প্রয়াস করলে গঙ্গা সন্তুষ্ট হয়ে তাঁকে বলেন যে তিনি স্বর্গ থেকে মর্ত্যে অবতীর্ণ হলে তার প্রপাতের প্রচণ্ড বেগ নিয়ন্ত্রণ করা অসম্ভব। এ-কাজ একমাত্র মহাদেবই করতে পারেন। তখন ভগীরথ ভগবান শিবের তপস্যা আরম্ভ করেন ও ভগবান শিব তুষ্ট হয়ে ভগীরথের প্রার্থনা অনুসারে স্বর্গ থেকে পতিত গঙ্গাদেবীকে তাঁর জটায় ধারণ করেন ও নদীরূপে মর্ত্যে বাহিত করেন। তারপর থেকে মহাদেবের আর এক নাম হয় গঙ্গাধর। ভগীরথের পেছনে অনুসরণকারী স্রোতটির নাম হয় ভাগীরথী।

এর পরে গঙ্গার বা ভাগীরথীর গতিপথে পড়ে জহ্নুমুনির আশ্রম। প্রবল স্রোতে আশ্রম ও যজ্ঞের সমস্ত উপকরণাদি ভেসে যায়। এতে অত্যন্ত ক্রুদ্ধ জহ্নু গঙ্গার সমস্ত জল পান করে ফেলেন। তখন দেবতারা তপস্যা করে সন্তুষ্ট করলেন মুনিবরকে। প্রীত জহ্নু কন্যারূপে কান থেকে, মতান্তরে জানু থেকে মুক্ত করলেন গঙ্গাকে। সেই থেকে গঙ্গার নাম জাহ্নবী। স্বর্গ মর্ত্য ও পাতাল— এই তিন পথে প্রবাহিত বলে গঙ্গার অপর নাম ত্রিপথগা। ব্রহ্মার বরে রাজা ভগীরথের জ্যেষ্ঠা দুহিতা গঙ্গা। তাই গঙ্গার আর এক নাম ভাগীরথী।

মহাভারতে গঙ্গা
মহাভারতের আদিপর্বের কাহিনি অনুসারে গঙ্গা কুরুরাজ শান্তনুর স্ত্রী। দেবব্রত ভীষ্মের মাতা। একবার মহর্ষি বশিষ্ঠের অভিশাপে অষ্টবসু তথা আট গণদেবতা শাপভ্রষ্ট হয়ে মানবরূপে জন্মগ্রহণ করেন। তখন তাঁরা নরজন্ম থেকে মুক্তির জন্য প্রার্থনা করেন গঙ্গার কাছে। অষ্টবসুর এই প্রার্থনা পূরণ করবার জন্য গঙ্গা এক সুন্দরী নারীমূর্তি ধারণ করেন। রাজা শান্তনুকে আকৃষ্ট করেন। তাঁরা বিবাহ করেন। তবে শর্ত ছিল, গঙ্গার কোনও কাজে রাজা বাধা দিলে সেই মুহূর্তে গঙ্গা চলে যাবেন তাঁকে ছেড়ে।

গঙ্গা শান্তনুর স্ত্রী হয়ে সাতপুত্রের জননী হন। কিন্তু জন্মমাত্রই প্রত্যেকটি সন্তানকে নিক্ষেপ করেন নদীগর্ভে। রাজা কষ্ট পেলেও প্রথমে কিছু বলেননি, কিন্তু এরপর অষ্টম পুত্রর ক্ষেত্রে আর চুপ থাকতে না পেরে পুত্রকে বিসর্জন দিতে বাধা দেন। রাজার শর্তভঙ্গের অপরাধে বিদায় নিলেন গঙ্গা। বিদায়কালে গঙ্গা তাঁর আত্মপরিচয় দিয়ে প্রকৃত ঘটনা জানালেন রাজাকে আর সঙ্গে নিয়ে গেলেন নবজাতককে। কয়েক বছর পরে রাজোচিত শিক্ষা দিয়ে পুত্রকে শান্তনুর হাতে অর্পণ করলেন গঙ্গা। গঙ্গার এই পুত্রই দেবব্রত ভীষ্ম।

মহাভারতে বিভিন্ন তীর্থের মাহাত্ম্য প্রসঙ্গে বহুবার গঙ্গার উল্লেখ পাওয়া যায়। মহাতেজা শান্তনুর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র মহাবলী ভীষ্ম তাঁর পারলৌকিক ক্রিয়ার অনুষ্ঠান করেন গঙ্গাদ্বারে। এমনকী ধৃতরাষ্ট্র, কুন্তী ও গান্ধারীর মৃত্যু হলে যুধিষ্ঠিরাদি পঞ্চপাণ্ডব তাঁদের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন করেন গঙ্গাদ্বারে। তাঁদের ভস্ম ও অস্থি বিসর্জন দেন গঙ্গাজলে। গঙ্গাদ্বার বা হরিদ্বারের গঙ্গাতীরে ঋষিশ্রেষ্ঠ পুলস্ত্য মহামতী ভীষ্মের কাছে গঙ্গার মহিমা কীর্তন করেন। পরে রাজা যুধিষ্ঠিরকে মুনিশ্রেষ্ঠ দেবর্ষি নারদ এ-সম্পর্কে জানান ও গঙ্গার তীরের তীর্থের মহিমা বর্ণনা করেন। গঙ্গার মাহাত্ম্যে অশেষ বিশ্বাস যে, মহাভারতীয় যুগেও ছিল অভ্রান্ত প্রমাণ এটি।

পুরাণে গঙ্গা
পুরাণের কালেও গঙ্গার গুরুত্ব বজায় ছিল। গঙ্গাদ্বার তথা হরিদ্বারে পিতৃতর্পণকালে মহর্ষি দত্তাত্রেয়ের হাতের কুশ ভেসে যায় গঙ্গাস্রোতে। তখন মুনিবর যোগবলে গঙ্গার ধারাকে আবর্তন করিয়ে সেই কুশ ফিরিয়ে আনেন। সেই থেকে ঘাটটির নাম হয়েছে কুশাবর্ত। শিবপুরাণের মতে, মহর্ষি গৌতম গঙ্গাদেবীর আদেশক্রমে গঙ্গাদ্বারের নিম্নভাগে তৈরি করেন কুশাবর্ত তীর্থ। জ্ঞানসংহিতায় উল্লেখ আছে, ‘এই অনুত্তম তীর্থে স্নান করিলে মনুষ্যের মোক্ষলাভ হয়।’
শুধু তাই নয়, গঙ্গায় স্নানমাহাত্ম্য প্রসঙ্গে প্রশংসায় পঞ্চমুখ ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ, মৎস্যপুরাণ, স্কন্দপুরাণ, তন্ত্রশাস্ত্র ও একাধিক অন্যান্য পুরাণ। তন্ত্রশাস্ত্রে গঙ্গার মাহাত্ম্যকথা শিব পার্বতীকে বর্ণনা করেছেন।

ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে আছে, জ্যৈষ্ঠমাসের শুক্লপক্ষের দশমী তিথিতে গঙ্গাস্নান করলে দশবিধ পাপক্ষয় হয়ে থাকে। এ-জন্য ওই তিথিকে দশহরা বলা হয়।

দশহরা উৎসব
দশহরা গঙ্গা বা গঙ্গা দশেরার (Ganga Dussehra) বা শ্রীশ্রীগঙ্গাপুজোকে গঙ্গাবতরণও বলা হয়। পুরাণ অনুসারে পবিত্র গঙ্গানদী এই দিনে স্বর্গ থেকে পৃথিবীতে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। জ্যৈষ্ঠ মাসের শুক্লপক্ষের দশমীতে গঙ্গা দশরার পুজো করা হয়। দশহরা শব্দটি এসেছে সংস্কৃত থেকে। ‘অহ’ শব্দের অর্থ দিন। দশ+অহ = দশারহ = দশহরা।

আমরা সবাই জানি যে মা দুর্গার মহিষাসুরবধের বিজয়োৎসবকে সারা ভারতবর্ষে দশহারা বা দশেরা বলে। আমাদের পশ্চিমবঙ্গে তা বিজয়াদশমী হিসেবে পালিত হয়। কিন্তু অন্য পৌরাণিক কাহিনি অনুসারে জৈষ্ঠ্যমাসের এই শুক্লা দশমীতে দশহরার দিন দুর্গার মহিষাসুর বধের কথা শুম্ভ ও নিশুম্ভ জানতে পারলে তারা দেবীর সঙ্গে যুদ্ধ করতে বিন্ধ্যাচলে যায়। সেখানে দেবী বিন্ধ্যবাসিনী তাদের বধ করেন। যোগমায়া বিন্ধ্যবাসিনী দুর্গা মহিষাসুর বধের পর দুর্গার তেজ থেকেই আবির্ভূতা হয়েছিলেন এই পর্বত শিখরেই।

স্কন্দপুরাণ অনুসারে এই বিন্ধ্যবাসিনী দেবী দুর্গাসুরকেও বধ করেন। অতএব অরণ্য ষষ্ঠীর দিনে বিন্ধ্যবাসিনী দুর্গার পুজোর পরে এই দশহরার তাৎপর্যও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ।

দশহরার দিন গঙ্গাস্নান করে মা গঙ্গাকে পুজো দেওয়া হয়। শাস্ত্রমতে দশহরা তিথি পূর্ব দশজন্মের কৃত পাপ এবং এ জন্মের দশটি পাপ হরণ করে আর অযুত অশ্বমেধ যজ্ঞের যে ফল তা লাভ করা যায়। এই যোগ ভগীরথ দশহরা নামে পরিচিত। এই বিশেষ দিনটিতে প্রধান ধর্মীয় কর্ম হল গঙ্গাস্নান এবং দশ ফুল, দশ ফল এবং দশ প্রদীপ জ্বালিয়ে গঙ্গার পুজো। স্মার্ত মতেও জ্যৈষ্ঠের শুক্লা দশমীতে গঙ্গাস্নানে দশবিধ পাপের মুক্তি ঘটে।

গঙ্গাবতরণের পৌরাণিক কাহিনির আড়ালে লুকিয়ে থাকা সহজ সত্যটি হল, কৃষিপ্রধান দেশে কৃষির প্রয়োজনে বহু সময় খাল কেটে জলধারাকে কৃষিভূমির কাছে নিয়ে আসা হয়েছে। তাই ভগীরথের গঙ্গা আনয়নের একটা লৌকিক ব্যাখ্যাও আছে। বর্ষার ঠিক আগে তাই দশহরা উৎসব পালনের আলাদা একটি তাৎপর্য আছে। তাই সম্ভবত এই নদী-পুজো লৌকিক সংস্কৃতির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি ভাবে জড়িত।

নবদ্বীপে দশহরা
বাংলায় সেন রাজাদের শাসনকালে সেন রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায় দশহরা তিথিতে সাড়ম্বরে গঙ্গাপুজো হত নবদ্বীপে। বড় বড় বাণিজ্যতরীতে মা গঙ্গার মূর্তির পুজো হত। ঘাটের ধারে ভোর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত বসত জমজমাট মেলা। চলত দান–ধ্যান, ভূরিভোজ। সেন রাজারা উপস্থিত থাকতেন সেই মেলায়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রাচীন সেই উৎসবের জৌলুস আর তেমন নেই। তবু পুরনো রীতি মেনে এখনও নবদ্বীপ, কৃষ্ণনগর, ঘূর্ণি, গোয়ারি প্রভৃতি অঞ্চলে বিভিন্ন ঘাটে এই দিনটিতে পুজো–হোম, প্রসাদ বিতরণ, গঙ্গায় স্নান— সবই হয়। নদীর পারে মেলাও বসে।

দশহরা ও মনসাপুজো
আবার জৈষ্ঠ্যমাসের শুক্লপক্ষে অরণ্যষষ্ঠীর পাঁচদিনের মাথায় যে শুক্লাদশমী তিথি, তা যদি হস্তানক্ষত্র যুক্ত হয় তবে সেদিনেই একত্রে দশহরা, গঙ্গা ও মনসাপুজো পালিত হয়। গঙ্গাপুজোর সঙ্গে ঐদিন মনসামঙ্গলের গান করার রীতি। বছরের নানা সময়ে বিভিন্ন স্থানে মনসাপুজোর চল হলেও জৈষ্ঠ্যমাসের শুক্লা দশমীতে দশহরার দিন বছরের প্রথম স্নানযাত্রা শুরু হয় মা মনসার।

মনসা লোকায়ত দেবী হলেও রাঢ়বঙ্গে তিনি বেশ জনপ্রিয়। তাঁর একটি পৌরাণিক পরিচয়ও রয়েছে। মনসা একাধারে সর্পদেবী। অন্যদিকে সন্তানসন্ততিরও বা সৌভাগ্যকামনারও দেবী। মনসামঙ্গল অনুযায়ী তিনি শিবের মানসকন্যা আর নাগরাজ বাসুকীর ভগিনী। যেহেতু বর্ষার আগেই সাপেদের বাড়বাড়ন্ত হয়, সেদিক থেকে তাই দশহরার দিনে মা মনসার পুজো করে তাঁকে তুষ্ট রাখা হয়। তবে আর পাঁচটি ব্রতের মতোই আত্মকল্যাণের সঙ্গে পারিবারিক কল্যাণেই এই পুজো।
সবশেষে বলা যায়, উৎসবের রকম ফের হয়। স্থান-কাল ভেদে বদলে যায় আরাধ্য দেবদেবী। কিন্তু দেশের বিভিন্ন প্রান্তে উৎসবের সুরটি থাকে অমলিন যা বহু মানুষকে বেঁধে রাখে সম্প্রীতির আদর্শে। দশহরা উৎসবের মধ্যেও মিশে থাকে আনন্দ, সুখ ও জাগতিক সমৃদ্ধির সুরটি।