ডাঃঅশোক রায়

বর্ষা এখনো যায়নি। আকাশে কালো মেঘের আনাগোনা। কখনো টিপটিপ তো কখনো ঝমঝম। বাইরে ন‍া কি ভ‍্যাপসা গরম। কিন্তু আমি কি করে জানবো? আমার বাড়িতে তো চব্বিশ ঘন্টা বাতানুকুল যন্ত্র চলে,তাই গরমটা মালুমই হয় না। বেশ ভাবলুম দুপুরে একটা জমিয়ে ঘুম দেব। এমনিতেই এখন দোকানে খদ্দেরের সংখ্যা কম, আর যারা আসে তাদের নজর আমার সতীন টক-দিদির ওপর।

সুন্দর “মাটির” তৈরি বিছানা, গায়ে ধবধবে সাদা “কাগজের” চাদর। সবেমাত্র চোখদুটো বুঝে আসছিল। হঠাৎ একজোড়া দস্তানা পরা হাত আমাকে প্রায় পাঁজাকোলা করে ঘর থেকে বার করে নিল। চাদরের এক ফাঁক দিয়ে কাউন্টারের ওপারে এক সবুজ জামা পরা মূর্তিমানকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। কি সাহস! করোনার কাছে তো একেবারে কুপোকাত, তাও খাবার লোভ যায়নি এতটুকু। সাত-সতেরো ভাবার আগেই দস্তানা পরা লোকটা আমার সারা শরীর ক্ষতবিক্ষত করতে লাগলো। উফ্, সে কি যন্ত্রণা। এরমধ্যে সেই সবুজ জামাপরা লোকটি বলতে লাগলো–” দাদা, আমার কিন্তু মাথাটা চাই”। আমার শরীর টাকে খণ্ড – বিখণ্ড করে ছোট ছোট অংশ তুলে দিল লোকটার হাতে। বুঝলাম আমার পৃথিবীর আলো দেখার সময় প্রায় শেষ। কোনো মোটা গোঁফওয়ালা বা কোনো টাকমাথা লোকের রসনাতৃপ্তির মধ‍্যে দিয়েই আমার পঞ্চত্বপ্রাপ্তি হতে চলেছে।

ওরে অর্বাচীনের দল, এতোই যদি ক্ষমতার দম্ভ, করোনার কাছে পরাস্ত কেন? সেই কোন যুগ থেকে আমি বাঙালির পাতে আমিষ ও মিষ্টান্নর মধ‍্যে সেতুবন্ধনের কাজ করে চলেছি, তাও কি তোদের কোনো মায়াদয়া নেই? হায় রে মনুষ‍্যজাত। আমার বংশ-পরিচয়টুকু জানার চেষ্টাও কেউ করেনা। ওপার বাংলার বগুড়ার ঘেঁটু ঘোষের কথা কি তোমরা জানো? আরে তিনিই তো আমার প্রপিতামহ। বাবার মুখে শুনেছি, বগুড়ার নবাব আলতাফ আলি চৌধুরী না কি আমার প্রপিতামহকে এক বিরাট জমি দিয়েছিলেন মিষ্টির কারখানা ও দোকান তৈরীর জন‍্য। আজও সমগ্র ওপার বাংলায় রমজানে সাহরী ও ইফতারে বগুড়ার হাঁড়ি দই, সরা দই বা কাপ দইয়ের জুড়ি মেলা ভার। ষাটের দশকের প্রথম ভাগে পাকিস্তানের তদানীন্তন প্রেসিডেন্ট বৃটেনের রাণী এলিজাবেথের সহানুভূতি আদায় করতে আমার শরণাপন্ন হয়েছিলেন। ভাবা যায়!!!

তবে আমার আত্মকাহিনীর পাঠক-পাঠিকারা যেন না ভাবে যে আমি ওপার বাংলারই একচেটিয়া সম্পত্তি। আমার মায়েরা কিন্তু এদেশী। নবদ্বীপের কালীপদ মোদকের ঘরে জন্ম আমার দিদিমার। গায়ের রং টুকটুকে লাল, তাই নামকরণ হলো লালদই।

বাংলা সাহিত্যে আমার কদর কিন্তু ঈর্ষণীয়। তা সে কবিগুরুর “চণ্ডালিকা” গীতিনাট‍্যের প্রকৃতির কন্ঠে “দই চাই গো, দই চাই” হোক বা মুকুন্দরামের বর্ণনায় কালকেতুর রসনাতৃপ্তি হোক। দ্বাদশ শতকের কবি শ্রীহর্ষর ” নৈষধী চরিত” রচনায় আমাকে বলা হয়েছিল ” অমৃতের হ্রদ থেকে তুলে আনা পাঁকের মতো “। জনৈক চিনা পরিব্রাজক হিসং না কি খাদ‍্যরসিক বাঙালিদের রাই- সরষের তীব্র ঝাল থেকে রক্ষা পেতে আমাকে চেটেপুটে খেতে দেখেছিলেন আর সেটা তিনি লিখেও গেছিলেন।

থাক ওসব পুরনো কথা। আমি যুগোত্তীর্ণ, আমি অমর। তাই আমার ” মাথা খাবার ” দুরভিসন্ধি ধোঁপে টিকবে না। বরং আমাকে সমর্যাদায় তোমাদের ঘরে আমন্ত্রণ জানাও। দক্ষিণের “কামধেনু”, ” যাদব দাশ” বা উত্তরের “অমৃত”, ” চিত্তরঞ্জন” সুইটস যেতে না পারলেও আফশোস কোরো না। তোমার বাড়ির গলির মাথার দোকানটাতেও আমার দেখা মিলবে। মায়ের পুজো আর আমি থাকবো না, একি কখনো হয়?

আরও পড়ুন-আমার প্রথম প্রেম